বান্দরবানের লামা উপজেলার কলাঝিরি মংপ্রুপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ঘিরে তামাক ক্ষেত।
বান্দরবান প্রতিনিধি ::::
সরকারি কাগজপত্রে পার্বত্য চট্টগ্রামে একদিকে প্রতিবছর ডাল, সিম, আলু, তরমুজ, বাদাম, আখ, ভুট্টা চাষ বৃদ্ধির তথ্য সন্নিবেশিত হচ্ছে।
অন্যদিকে রবি ও শীতকালীন শস্য চাষের জমিগুলো হু হু করে রূপান্তরিত হচ্ছে বাণিজ্যিক তামাক চাষের জমিতে। আর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে ‘সবজি চাষের ভাণ্ডার’ নামে পরিচিত বান্দরবানে জেলার বাইরে থেকে ঢুকছে আলু, পটল, সিম, লাউ, মিষ্টি কুমড়া। তরমুজ, ফুটি, মুলা-গাজর সবকিছুর জন্যই বাড়ছে পরনির্ভরতা। আইনি চাপ থেকে বাঁচতে বাণিজ্যিক তামাক কম্পানিগুলো তামাক চাষের মোট জমির পরিমাণ কম দেখিয়ে পরিবেশবাদীদের চোখে ধুলো দিচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর এবং উপজেলা কৃষি অফিসগুলোর শস্য চাষের ক্রমবর্ধমান তথ্য তাদের জন্যে ‘শাপে বর’ হচ্ছে। তামাক চাষ বাড়ছে, নাকি কমছে-এমন প্রশ্ন করা হলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের বান্দরবানস্থ উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আলতাফ হোসেন জানান, ২০১৪ সালে বান্দরবান জেলায় তামাক চাষের মোট জমির পরিমাণ ছিল ২০০০ থেকে ২২০০ একর। বাণিজ্যিক তামাক চাষ নিরুৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রায় ৫০০ থেকে ৭০০ বিঘা (প্রায় ২০০ একর) জমিতে অন্য অর্থকরী ফসল উৎপাদনে বিশেষ প্রণোদনার কারণে কৃষক শস্য চাষে আগ্রহী হওয়ায় গত কয়েক বছর ধরে এই জেলায় তামাক চাষের মোট জমির পরিমাণ বাড়াতে পারছে না কম্পানিগুলো। তবে এক বেসরকারি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, চলতি তামাক উৎপাদন মৌসুমে বান্দরবান জেলায় প্রায় ৬ হাজার একর উর্বর জমিতে তামাক চাষ হয়েছে।
মুখে চাষের জমি কমে আসার কথা প্রচার করলেও চলতি বছরে তামাক কম্পানিগুলোর মোট ক্রয়ের তথ্য বিবেচনা করলেই দেখা যাবে, তামাক চাষের কাজে দাবিকৃত পরিমাণের তিনগুণ জমি ব্যবহৃত হচ্ছে।
বহুজাতিক কম্পানি ব্রিটিশ-আমেরিকান টোবাকো বাংলাদেশ লিমিটেড (বিএটিবি)-এর এক তথ্যমতে, সদ্য সমাপ্ত তামাক মৌসুমে বান্দরবান, লামা, আলীকদম, থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়ি এলাকা থেকে তারা কিনেছে এক কোটি কেজি প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাত তামাক। অন্য দেশীয় কম্পানিও সম পরিমাণ তামাকপাতা ক্রয় করেছে। তামাক কম্পানিগুলোর হিসাব অনুযায়ী প্রতি একর জমিতে ৮০০ থেকে ১০০০ কেজি তামাকপাতা উৎপাদিত হয়। এই হিসাব অনুযায়ী ২ কোটি কেজি তামাক উৎপাদনে ২০ থেকে ২৫ হাজার একর জমি ব্যবহৃত হওয়ার কথা। কিন্তু কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ এবং তামাক কম্পানিগুলো বলছে, সর্বোচ্চ ২২০০ একর জমিতে তারা তামাক চাষ করছে।
পরিবেশবাদীরা বলছেন, তথ্যগত এই জালিয়তির কারণেই তলে তলে প্রতিকারহীন গ্রাসের কবলে পড়ছে চাষের উর্বরা জমিগুলো।
বান্দরবানের সাংবাদিক আলাউদ্দিন শাহরিয়ার বলেন, ‘জীবন ও পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি রোধে তামাক চাষ নিয়ন্ত্রণ করার জন্য ২০১২ সালে বান্দরবান জেলা জজ আদালতে একটি মামলা হয়। শুনানি শেষে আদালত প্রতিবছর সর্বোচ্চ ১০০০ একর জমিতে তামাক চাষের অনুমতি প্রদান করেন। এ অবস্থায় আইনি নিয়ন্ত্রণ এড়াতে তামাক কম্পানিগুলো বাস্তব পরিমাণের চেয়ে অনেক কম জমিতে তামাক চাষের তথ্য দিয়ে আদালত ও পরিবেশবাদীদের বিভ্রান্ত করছে। ’
কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চলতি বছরে প্রতিকেজি তামাক পাতা ক্রয় করা হয়েছে ৮১ টাকা থেকে ১৫০ টাকা দরে। ফলে চাষিরা ক্রমবর্ধমান হারে তামাক চাষে আগ্রহী হচ্ছেন।
এক হিসাবে দেখা গেছে, এক একর জমিতে আলু-বাদাম বা অন্য ফসল চাষ করে উৎপাদন ব্যয় মিটিয়ে ৫০ হাজার টাকাও কৃষকের হাতে থাকে না।
অন্যদিকে এক একর জমিতে তামাক চাষ করে একজন কৃষক ১ লাখ ২০ হাজার থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা ঘরে তুলতে পারেন। এই কারণে সরকারি প্রণোদনা ও মাঠ পর্যায়ের কৃষি কর্মকর্তাদের কোনো পরামর্শ গ্রহণ করতে চাইছে না চাষি।
কৃষিবিদ আলতাফ হোসেন বলেন, ‘বিশেষ বিশেষ সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু ধারাবাহিক সুবিধা না থাকায় কৃষি কর্মকর্তাদের হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও রবি ও শীতকালীন শস্য চাষ বৃদ্ধি করে তামাক চাষের জমির পরিমাণ হ্রাস করা যাচ্ছে না। ’ তিনি জানান, জমিতে তামাক চাষ করেই একজন চাষি তাঁর বার্ষিক আয় নিশ্চিত করে ফেলতে পারেন। কিন্তু কৃষি ফসল চাষে প্রাকৃতিক কারণে উৎপাদন হ্রাস কিংবা ন্যায্য মূল্যসহ পণ্য বিক্রির কোনো নিশ্চয়তা নেই। কোনো কোনো মৌসুমে উৎপাদন ভালো হলে তা পানির দরে বিক্রি করতে গিয়ে উৎপাদন ব্যয়ও তুলতে পারেন না কৃষক।
তিনি বলেন, ‘এই অবস্থা পরিবর্তনে বিশেষ বিশেষ প্রণোদনার পরিমাণ বৃদ্ধি এবং টানা কয়েক বছর ধারাবাহিকতা রক্ষা করা গেলে প্রান্তিক চাষিদের শস্য উৎপাদনে আগ্রহী করা যেতে পারে। ’
পাঠকের মতামত: